২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ঈমান : গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

-

ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো- বিশ্বাস করা, স্বীকার করা ও আস্থা স্থাপন করা। আর শরিয়তের পরিভাষায় ঈমান হলো, মহানবী সা: আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে দ্বীন হিসেবে অপরিহার্য যেসব বিষয় নিয়ে এসেছেন সেগুলোকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করা ও মেনে নেয়ার সাথে সাথে দৃঢ়বিশ্বাস ও প্রত্যয় ব্যক্ত করার নাম। ঈমান আনার কারণে ঈমানদার ব্যক্তি চিরকালের জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে। পক্ষান্তরে ঈমান বর্জনকারী কাফের ও বেঈমান লোক অনন্তকাল জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে!

ঈমান আনার উপায় : ঈমান আনার উপায় হলো- শতভাগ বিশ্বাস ও নিষ্ঠার সাথে কালিমায়ে তায়্যিবা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ পাঠ করা বা এ কথার সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই এবং হজরত মুহাম্মদ সা: আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। যখন কোনো ব্যক্তি আন্তরিক বিশ্বাসের সাথে কালিমায়ে তায়্যিবার মর্ম উপলব্ধি করে উল্লিখিত সাক্ষ্য দেবে তখন সে ঈমানদার ও মুসলমান বলে গণ্য হবে। হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘ইসলাম হলো, তুমি এ কথার সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃতপক্ষে কোনো উপাস্য নেই এবং হজরত মুহাম্মদ সা: আল্লাহর রাসূল।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস-১)

ঈমান অনন্য নিয়ামত : ঈমান আল্লাহ প্রদত্ত এক অনন্য নিয়ামত! এই নিয়ামত প্রদানের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা মুসলিম জাতিকে ধন্য ও সম্মানিত করেছেন। মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘তারা মুসলমান হয়ে আপনাকে ধন্য করেছে মনে করে। বলুন, তোমরা মুসলমান হয়ে আমাকে ধন্য করেছ মনে করো না, বরং আল্লাহ ঈমানের পথে পরিচালিত করে তোমাদের ধন্য করেছেন।’ (সূরা হুজুরাত : ১৭) ঈমানের দৌলত প্রদান করার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা আমাদের ওপর মহা অনুগ্রহ করেছেন! চিরকালীন জাহান্নাম থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন! কেননা, বেঈমান কাফেররা অনন্তকাল জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে! তারা চিরকাল দোজখের শাস্তি ভোগ করবে! আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যদি সারা পৃথিবী পরিমাণ স্বর্ণও তার পরিবর্তে দেয়া হয়, তবুও যারা কাফের হয়েছে এবং কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে তাদের তওবা কবুল করা হবে না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি! পক্ষান্তরে তাদের কোনো সাহায্যকারী নেই।’ (সূরা আলে ইমরান : ৯১)

শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড ঈমান : শ্রেষ্ঠ ও উত্তম হওয়ার ইসলাম-সমর্থিত একমাত্র মানদণ্ড হলো বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর ওপর ঈমান আনয়ন ও মহানবী সা:-এর নবুয়ত ও রিসালাতের ওপর বিশ্বাস স্থাপন। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে অবিশ্বাসী বেঈমান কাফেরদের সৃষ্টির নিকৃষ্ট ও বিশ্বাসী মুমিন মুসলমানদের সৃষ্টির উৎকৃষ্ট আখ্যায়িত করে আল্লাহ বলেছেন, ‘আহলে-কিতাব ও পৌত্তলিকদের মধ্যে যারা কাফের, তারা জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে থাকবে। তারাই সৃষ্টির অধম। যারা ঈমান আনয়ন করে ও সৎকর্ম করে, তারাই সৃষ্টির উত্তম!’(সূরা বাইয়িনাহ : ৬-৭)

ঈমানের স্তম্ভসমূহ : ঘর ও ভবনের যেমন স্তম্ভ ও খুঁটি রয়েছে ঠিক তেমনিভাবে ঈমানেরও স্তম্ভ ও খুঁটি রয়েছে। যে ব্যক্তির মধ্যে ঈমানের স্তম্ভগুলো যত বেশি শক্তিশালী রূপে পাওয়া যাবে সেই ব্যক্তি তত বেশি পাক্কা ঈমানদার ও খাঁটি মুমিন বলে গণ্য হবে। তাই ঈমানের স্তম্ভগুলোকে শক্তিশালী ও মজবুত করা প্রত্যেক ঈমানদারের অবশ্য কর্তব্য। ঈমানের সাতটি স্তম্ভ রয়েছে। সেগুলো হলো- ১. একক উপাস্য হিসেবে আল্লাহকে বিশ্বাস করা; ২. আল্লাহর ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা; ৩. সব আসমানি কিতাবের ওপর বিশ্বাস পোষণ করা; ৪. সব নবী ও রাসূূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা; ৫. তাকদির বা ভাগ্যের ভালো-মন্দের ওপর আল্লাহর ক্ষমতা রয়েছে বলে বিশ্বাস করা; ৬. পরকালের প্রতি বিশ্বাস লালন করা ও ৭. মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত হওয়ার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা। হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘ঈমান হলো, তুমি আল্লাহ, তার ফেরেশতাকুল, তার কিতাবসমূহ, তার প্রেরিত নবীগণ ও শেষ দিনের ওপর ঈমান রাখবে এবং তুমি তাকদির ও এর ভালো-মন্দের প্রতিও ঈমান আনয়ন করবে।’ (সহিহ মুসলিম: ১)

ঈমানদারদের আপ্যায়ন : জান্নাত হলো চির-শান্তির স্থান। সেখানকার সব কিছুই সুন্দর ও আকর্ষণীয় বস্তুরাজি দিয়ে সজ্জিত। জান্নাতের ঘরবাড়ি, আসন ও আসবাবপত্রের সব কিছু স্বর্ণ-রৌপ্য ও মণিমুক্তা দিয়ে নির্মিত। জান্নাতে থাকবে রেশমের গালিচা, দুধ ও মধুর নহর এবং মিষ্টিপানির স্রোতধারা। বস্তুত আনন্দ উপভোগের সব উপকরণই জান্নাতে বিদ্যমান থাকবে। জান্নাতের আটটি স্তর রয়েছে। এই স্তরগুলোর মধ্য থেকে সর্বোচ্চ স্তর জান্নাতুল ফিরদাউসে বিশ্বাসী ঈমানদার ও সৎকর্মশীল মুসলমানদের আপ্যায়ন করা হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা ঈমান আনয়ন করে ও সৎকর্ম সম্পাদন করে, তাদের আপ্যায়নের জন্য রয়েছে জান্নাতুল ফেরদাউস। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে, সেখান থেকে স্থান পরিবর্তন করতে চাইবে না।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ১০৭-১০৮)

ঈমান সফল হওয়ার মাধ্যম : ইসলামের অনুসারী মুমিন মুসলমান ছাড়া অন্য সব মানুষ অনন্তকাল দোজখের আগুনে দগ্ধিভূত হবে। কুরআন শরিফে এসেছে, ‘যাকে দোজখ থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, সে সফল হয়ে যাবে।’ (সূরা আল ইমরান : ১৮৫) অপর দিকে, ঈমানদার মুমিন মুসলমানদের সফল হিসেবে উল্লেখ করে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘মুমিনগণ সফল হয়ে গেছে’। (সূরা মুমিনুন:১) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেছেন, ‘যারা ঈমান আনয়ন করেছে সেসব বিষয়ের ওপর যা কিছু তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং সেসব বিষয়ের ওপর যা তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। আর পরকালকে যারা নিশ্চিত বলে বিশ্বাস করে। তারাই নিজেদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে সুপথপ্রাপ্ত, আর তারাই যথার্থ সফলকাম।’ (সূরা বাকারা : ৪-৫)

কাফেররা চির-জাহান্নামি : যারা বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা: আনীত ধর্মমতের ওপর ঈমান আনয়ন ও বিশ্বাস স্থাপন না করে কাফের বা বেঈমান থাকবে তারা অনন্তকাল জাহান্নামের আগুনে প্রজ্বলিত হবে। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে এসেছে, ‘নিশ্চয় যারা কাফের হয়, তাদের ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি আল্লাহর সামনে কখনো কোনো কাজে আসবে না। আর তারাই হলো জাহান্নামের আগুনের অধিবাসী। তারা সে আগুনে চিরকাল থাকবে।’ (সূরা আলে ইমরান: ১১৬) চিরকাল জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর রিসালতের ওপর ঈমান আনয়ন ও বিশ্বাস স্থাপন করার বিকল্প নেই।

সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলাম : ইসলাম ও ঈমান সমান্তরালে অবস্থান করে। ঈমান অন্তরের মাধ্যমে বিশ্বাস করার বিষয় এবং ইসলাম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে আমল করার বিষয়। এই ঈমান ও ইসলাম একটি অপরটির পরিপূরক। এতদুভয়ের একটি ছাড়া অপরটি অপূর্ণাঙ্গ রয়ে যায়। ইসলাম ধর্মের অনুসারীরাই ঈমানদার বলে গণ্য। আজকের পৃথিবীতে ইহুদিবাদ, খ্রিষ্টবাদ, নাস্তিক্যবাদ, ব্রাহ্মণ্যবাদ, হিন্দুত্ববাদ ও বিবর্তনবাদসহ বহু বাদ-মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর নিকট থেকে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা: আনীত ইবরাহিমি ধর্মবিশ্বাসপ্রসূত একত্ববাদী ইসলাম ছাড়া অন্য সব ধর্ম ও মতবাদ অগ্রহণযোগ্য ও বাতিল। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম তালাশ করে, কখনো তা গ্রহণ করা হবে না এবং পরকালে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (সূরা আলে ইমরান: ৯১) ইসলামকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম আখ্যায়িত করে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘যে আল্লাহর নির্দেশের সামনে মস্তক অবনত করে সৎকাজে নিয়োজিত থাকে এবং ইবরাহিমের ধর্ম অনুসরণ করে, যিনি একনিষ্ঠ ছিলেন, তার চাইতে উত্তম ধর্ম আর কার?’ (সূরা নিসা: ১২৫)

লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা


আরো সংবাদ



premium cement